৯.১.১ বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
তোমরা ইতোমধ্যে আবহাওয়া, জলবায়ু এবং তাদের পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে জেনেছ। এখন আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল আর তার প্রভাব সম্পর্কে জেনে নিই।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এর মাঝেই লক্ষণীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। নিচে এগুলো তুলে ধরা হলো।
ঋতুর পরিবর্তন
বাংলাদেশ হয় ঋতুর দেশ এবং একসময় প্রতিটি ঋতুর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে এ ঋতুচক্রের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হতে দেখা যাচ্ছে। আষাঢ় ও শ্রাবণ, দুই মাস বর্ষাকাল হলেও দেখা যাচ্ছে যে আশ্বিন মাসেও ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে, শুধু তা-ই নয়, তা অসময়ে বন্যার কারণ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে শীতকাল ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এটিও লক্ষণীয় যে গ্রীষ্মকালে অনেক বেশি গরম পড়ছে এবং মাঝে মাঝে দেশের কোনো কোনো এলাকায় দিনের তাপমাত্রা ৪৫-৪৮° সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। অন্যদিকে শীতের সময় কখনো কখনো তাপমাত্রা অনেক বেশি কমে যাচ্ছে। অস্বাভাবিক এই গরম আর শীতের কারণে কোথাও কোথাও প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটছে।
বন্যা
নদীমাতৃক বাংলাদেশে বন্যা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার এবং অনেকাংশেই দরকারি। বন্যার ফলে জমিতে পলি পড়ে, যা জমির উর্বরতা বাড়ায়, এতে ফসল উৎপাদন ভালো হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে জলবায়ুজনি পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন এবং অসময়ে প্রলংয়করী বন্যা লক্ষ করা যাচ্ছে। আগের দিনে এ ধরনের বন্যা যে হয়নি তা নয়, তবে এত ঘন ঘন হয়নি। ১৯৮৮, ১৯৯৫, ১৯৯৮, ২০০৫ সালে বাংলাদেশে প্রসংয়করী বন্যায় জানমালের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।এ কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশের যে সকল অঞ্চল বন্যাপ্রবণ নয়, যেমন: যশোর, ঢাকা সে সকল অঞ্চলও মাঝে মাঝে এখন বন্যায় প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে।
নদীভাঙন
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীভাঙন একটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও সাম্প্রতিককালে তা অনেক বেড়ে গিয়েছে। এতে একদিকে যেমন বিপুল জনগোষ্ঠী ঘর-বাড়ি হারিয়ে গৃহহীন হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে আবাদি জমিও নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বিশাল জনসংখ্যার দেশটির জন্য এটি মারাত্মক একটি সমস্যা। নদীভাঙনের ফলে গৃহহারা লোকজন যাযাবরের মতো বা শহর অঞ্চলের বস্তিতে অমানবিক জীবনযাপন করছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিগত তিন দশকে প্রায় ১৮০,০০০ হেক্টর জমি শুধু পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা এই তিন নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে।
খরা
কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় খরা বাংলাদেশের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা। এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, যা বৃষ্টিপাতের উপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলছে। কোনো কোনো অঞ্চলে বৃষ্টিপাত একেবারেই কমে গিয়ে খরার সৃষ্টি করছে। জলবায়ুজনিত সৃষ্ট খরায় বাংলাদেশে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
পানির লবণাক্ততা
জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি মূল ভূখণ্ডে ঢুকে নদ- নদী, ভূগর্ভের পানি এবং আবাদি জমিও লবণাক্ত হয়ে পড়বে। তখন একদিকে যেমন খাওয়ার পানির প্রচণ্ড অভাব দেখা যাবে, অন্যদিকে তেমনি জমিতে লবণাক্ততার জন্য ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হবে। অতি সাম্প্রতিককালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৮৩০,০০০ হেক্টর জমি লবণাক্ততার কারণে কৃষি অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কাজেই জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ত পানির কারণে বাংলাদেশে ভয়াবহ খাদ্যঝুঁকিতে পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হয় তাহলে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে ২১০০ সালের মধ্যে ৩০% খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাবে। ২০৫০ সাল নাগাদ চাল আর গমের উৎপাদন যথাক্রমে ৮.৮% এবং ৩২% হ্রাস পাবে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলীয় বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার প্রায় ১৩% কৃষিজমি এর মাঝেই লবণাক্ততার শিকার হয়ে গেছে। ২০৫০ সাল নাগাদ তা ১৬% এবং ২১০০ সাল নাগাদ সেটি ১৮% এ পৌঁছাবে।
সামুদ্রিক প্রবাল ঝুঁকি
সামুদ্রিক প্রবাল তাপমাত্রার প্রতি খুব সংবেদনশীল। সাধারণত ২২-২৮° সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রবালের জীবনযাপনের জন্য উপযোগী। এই তাপমাত্রার ১-২° বেড়ে গেলেই তা প্রবালের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে কাজ করে। এক গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬০ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যে পরিমাণ প্রবাল ছিল, ২০১০ সালে তার প্রায় ৭০% বিলীন হয়ে গেছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এক্ষেত্রে পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি ছাড়াও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা না থাকাও এর অন্যতম কারণ
বনাঞ্চল
বাংলাদেশের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন হলো সুন্দরবন, যা শুধু যে জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ এক বন তা নয়, এটি আমাদের মহামূল্যবান সম্পদ। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এছাড়া এই অঞ্চলে সাইক্লোন, হ্যারিকেন প্রতিরোধে এই সুন্দরবন রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। সাম্প্রতিককালের ঝড়ে এর বড় একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে সমুদ্রের পানির উচ্চতা যদি ৪৫ সেন্টিমিটার বাড়ে, তাহলে আমাদের একমাত্র এই ম্যানগ্রোভ বনের ৭৫% পানির নিচে তলিয়ে যাবে। আর যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়ে, তাহলে প্রায় পুরো সুন্দরবন এবং এর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে।
মৎস্যসম্পদ
এক সময় বাংলাদেশের নদ-নদী, পুকুর কিংবা বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। নদীমাতৃক বাংলাদেশের অনেক নদীতে এখন আর আগের মতো পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মাছের বাসস্থান, খাদ্য সংগ্রহ এবং জৈবিক নানা প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে, এমনকি মাঝে মাঝে মাছ মারাও যায়। অনেক মাছ এবং মাছের পোনা পানির তাপমাত্রা ৩২° সেলসিয়াসের বেশি হলে মরে যায়। যেহেতু উচ্চ তাপমাত্রা (৩৫° সেলসিয়াস) রোগজীবাণু জন্মাতে সাহায্য করে, তাই তাপমাত্রা বেড়ে গেলে মাছে রোগ সংক্রমণ বেশি হয় এবং মাছের মড়ক লাগে। এছাড়া লবণাক্ত পানি মূল ভুখণ্ডের মিঠা পানিতে ঢুকে পড়লে মিঠা পানির মাছও আর বাঁচতে পারবে না ।
স্বাস্থ্যঝুঁকি
জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন প্রলয়ংকরী বন্যায় মারাত্মক পানিদূষণ হয় এবং পানিবাহিত নানা ধরনের রোগ, বিশেষ করে কলেরা ও ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে। অসময়ে বন্যা-খরার কারণে ফসলের ক্ষতি হয়, খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়, যা খাদ্যঘাটতি সৃষ্টি করে। পানির মতো বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা বাড়লে রোগজীবাণু বেশি জন্মাবে এবং নানারকম রোগ সংক্রমণ বেড়ে যাবে। আগে আমরা বাংলাদেশে কখনো অ্যানথ্রাক্স রোগের কথা শুনিনি। কিন্তু গত ৩-৪ বছর যাবৎ বর্ষার মৌসুমে বাংলাদেশে, বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ জেলায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। এতে গবাদিপশু ও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এ এলাকার পশু চিকিৎসক ও খামারিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ উপযুক্ত চিকিৎসায় ভালো হয়ে গেলেও গবাদিপশুর জন্য মৃত্যু অবধারিত। জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে অ্যানথ্রাক্সের মতো আরো অনেক প্রাণঘাতী রোগ-জীবাণু সৃষ্টি হতে পারে।
জীববৈচিত্র্য
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক উদ্যোগে নেওয়া না হলে জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে ৩০% জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
সাইক্লোন
সাইক্লোনের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরো ঘন ঘন এবং অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক আকার ধারণ করবে। এ বিষয়ে এই অধ্যায়েই তোমরা আরো বিস্তারিত জানবে।
জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্রভাব মূল্যায়নের জন্য গঠিত Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC)-এর চতুর্থ মূল্যায়ন রিপোর্ট (AR4) অনুযায়ী, জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের প্রভাব অনেক মারাত্মক এবং তা ধীরে ধীরে বেড়েই চলছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা গত ১০০ বছরে প্রায় ০.৭° সেলসিয়াস বেড়েছে। ১৯৬১-২০০৩ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা গড়ে প্রতিবছরে ১.৮ সেন্টিমিটার করে বেড়েছে। ইতোমধ্যেই পাহাড় পর্বতে জমে থাকা বরফের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। ১৯৯৫-২০০৬ পর্যন্ত ১২ বছরের মধ্যে ১১ বছরই প্রচণ্ড গরম পড়েছে। ঐ রিপোর্ট অনুযায়ী পরবর্তী দুই দশকে বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা প্রতি দশ বছরে গড়ে ০.২-০.৩° সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যাবে। অনুমান করা হচ্ছে, ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.১-৬.৪° সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। তখন নাতিশীতোষ্ণ ও বিষুবরেখা থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে পানির প্রাপ্যতা বেড়ে যাবে কিন্তু বিষুবরেখার নিকটবর্তী ও মাঝামাঝি স্থানে পানির প্রাপ্যতা কমে যাবে। অর্থাৎ কোনো কোনো অঞ্চলে প্রলংকরী বন্যার আশঙ্কা বেড়ে যাবে, আর কোনো কোনো অঞ্চল ভয়াবহ খরার কবলে পড়বে। ২০৮০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। সত্যি যদি তা-ই হয়, তাহলে বাংলাদেশের মতো অনেক দেশের বেশির ভাগ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। তোমরা কি জান, মালদ্বীপ ও ভারতের কিছু অংশ ইতিমধ্যেই পানিতে ডুবে গেছে? বিগত কয়েক বছরে সাইক্লোন, টাইফুন, হ্যারিকেন এরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেক বেড়েছে, ভবিষ্যতে তা আরো প্রকট হওয়ার আশংকা আছে। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, আইলা, সিডর, নার্গিস, ক্যাটরিনার কথা আমরা সবাই জানি। এ ধরনের ভয়াবহ দুর্যোগ আরো ঘন ঘন হবে এবং তার মাত্রা আরো ভয়ানক হতে পারে।